MY VOICE, MY COMMUNITY

Down Syndrome Society of Bangladesh

স্বপ্নজয়ের দূর্দমনীয় স্পৃহা

16 Oct, 2018

                        

ডাউন সিনড্রোম শিশুদেরও আছে স্বপ্নজয়ের দূর্দমনীয় স্পৃহা 

কাজী মোহিনী ইসলাম

ডাউন সিনড্রোম কোনো রোগ নয়, তাহলে এটি কি? অটিজমের সাথে আমাদের যতটা পরিচয় আছে, ডাউন সিনড্রোম শব্দটির সাথে সেভাবে পরিচয় নেই। ১৮৬৬ সালে ইংল্যান্ডের ডা. জন লেংডন ডাউন সর্ব প্রথম মানব শরীরের কোষে ক্রোমজমের একটি বিশেষ অবস্থাকে আবিস্কার করেন এবং তাঁর নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘ডাউন সিনড্রোম’। আরো সহজভাবে বলতে গেলে ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তির শরীরের কোষ সমূহে একটি অতিরিক্ত ক্রোমজম থাকে। সাধারণ মানুষের শরীরে যেখানে ক্রোমজমের সংখ্যা ৪৬টি সেখানে ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তির শরীরে ক্রোমজমের সংখ্যা থাকে ৪৭টি। ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তির ২১তম ক্রোমজমে তিনটি ক্রোমজম থাকে এবং এভাবে তাদের ক্রোমজমের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৭টি। শরীরে একটি অতিরিক্ত ক্রোমজমের বিশেষ অবস্থানের কারণেই ডাউন সিনড্রোম শিশুদের দেখতে সাধারণ শিশুদের চেয়ে একটু আলাদা মনে হয়। তাদের শারীরীক গঠনে কিছুটা পার্থক্য আছে। যেমন-কারো কারো মুখমণ্ডল স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ছোট হয়, অস্পষ্ট, থুতনি, চ্যাপ্টা নাক, খাট গলা, প্রশস্ত চোখের পাতা, জিভ কিছুটা লম্বা, হাত ও পায়ের আঙুলের মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা থাকে। বয়সের তুলনায় এসব শিশুদের উচ্চতা থাকে খুবই কম। কারো কারো মাংসপেশিতে থাকে শিথিলতা। কেউ কেউ ষ্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতে পারে না। কথা বলার সময় মুখের ভেতর কথাগুলো জড়িয়ে যায়। তবে এসব পার্থক্যগুলো ওদের চলার পথে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। যেহেতু ডাউন সিনড্রোম কোনো রোগ নয়, তাই এর নিরাময়ের প্রশ্নই আসে না। কেননা, একজন শিশু মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই কোষ বিভাজনের সময় একটি অতিরিক্ত ক্রোমজম দেহ কোষের ২১তম ক্রোমজমে অবস্থান করে। 
বিশ্বব্যাপী ডাউন সিনড্রোম নিয়ে কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ডাউন সিনড্রোম ইন্টারন্যাশনাল (ডিএসআই)-এর গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বে প্রতি ৮০০ শিশুর মধ্যে একজন ডাউন সিনড্রোম শিশু জন্মগ্রহণ করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে এখন প্রায় ৭ লাখ ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তি ও শিশু আছে। বাংলাদেশেও রয়েছে প্রায় দুই লাখ ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তি ও শিশু। 
ডাউন সিনড্রোম শিশুদের গ্রহণযোগ্যতা, অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ২১ মার্চ সারা বিশ্বে যখন ৯ম বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস পালন করা হচ্ছিল, তখন প্রথমবারের মত বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করা হয় বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস। 
প্রসঙ্গত: এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোম শিশু ও ব্যক্তিদের জীবন-মান উন্নয়নে কাজ করছে ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি অব বাংলাদেশ। জাতীয় পর্যায়ে ডাউন সিনড্রোম শিশু ও ব্যক্তিদের সামাজিক মর্যাদা, গ্রহণযোগ্যতা, অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ২ আগষ্ট প্রতিষ্ঠা লাভ করে এই সংস্থাটি। এই সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত রিসোর্স সেন্টার সমূহে ডাউন সিনড্রোম শিশু ও ব্যক্তিদের জন্য একীভূত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, শরীর চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নানামুখী কার্যক্রম চলছে। তাদের প্রচেষ্টায় এখন বেশ কিছু ডাউন সিনড্রোম শিশু-কিশোর জীবনের মূল স্রোতে ফিরতে শুরু করেছে। 
কোনো বিশেষ কোটায় নয়, একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থায় অংশ নিয়ে ওরা প্রমাণ করেছে ‘ডাউন সিনড্রোম কোনো রোগ নয়’। ওদের বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন নেই। শুধু একটু সচেতনতা, একটু ধৈর্য, নিয়মিত স্বাভাবিক জীবন চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে একজন ডাউন সিনড্রোম শিশু ও ব্যক্তি সহজেই সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে পারে। 
ডাউন সিনড্রোম শিশু ও ব্যক্তিরা সহজেই যে কোনো মানুষকে আপন করে নিতে পারে। ওরা নান্দনিক বোধ সমৃদ্ধ, খুব আদর ও ভালোবাসা প্রিয়। দারুন অভিমানী ও মেজাজী। ওরা যেমন মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতে জানে তেমনি ভালোবাসা পেতেও উদগ্রীব থাকে। ওরা খুবই মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন হয়ে থাকে। ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তি বা শিশুরা অলস, অক্ষম নির্জীব কিংবা কর্মবিমুখ নয়। ওদেরও আছে স্বপ্নজয়ের দূর্দমনীয় স্পৃহা। ডাউন সিনড্রোম শিশুদেরও লেখাপড়া, খেলাধূলা এবং শিল্প-সাহিত্যের প্রতি রয়েছে গভীর আগ্রহ। সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে তারাও সাধারণ শিশুদের মতো সব কিছু করতে পারে। পেতে পারে অন্য সব সাধারণ মানুষের মত জীবনের সকল সুযোগ-সুবিধা। আর এর জন্য প্রয়োজন ওদের মাঝে জীবন জয়ের স্বপ্নময় স্পৃহা তৈরি করা। 
তাদের এই দূরন্ত স্বপ্নময় সম্ভাবনার উদ্যমকে জাগিয়ে দেয়ার জন্য পরিবার তথা সমাজের প্রতিটি স্তরে এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম পরিবারকেই প্রবল আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে বিষয়টিকে অনুধাবন করতে হবে। আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে দিতে পারলেই ওরাও হতে পারে উন্নত চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ একজন মানুষ। আর ওদের মাঝে সেই স্বপ্ন প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়ার কাজটি করতে হবে আমাদেরই। তাহলেই ওরা স্বপ্নের শক্তি ঢেলে প্রতিবন্ধকতার দূর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে এগিয়ে যেতে পারবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে।

লেখক : কবি ও শিশু সাহিত্যিক; ইনস্ট্রাক্টর (স্পীচ এ্যাণ্ড মিউজিক), ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি অব বাংলাদেশ।